নতুন ফোন কেনার অনুভূতিটাই অন্যরকম, তাই না? পলিথিন সরিয়ে যখন চকচকে ফোনটা হাতে নেন, তখন মনে হয় এর চেয়ে ফাস্ট আর কিছুই হতে পারে না। অ্যাপে টাচ করলেই ওপেন হয়ে যাচ্ছে, গেম খেললে একদম মাখনের মতো চলছে, আর ক্যামেরার শাটারে চাপ দিলেই ছবি উঠে যাচ্ছে।
কিন্তু, ঠিক দেড় থেকে দুই বছর পর চিত্রটা পাল্টে যায়।
যে ফোনটা একসময় চিতার গতিতে চলত, সেটা এখন কচ্ছপের মতো ধীর। ফেসবুক ওপেন হতে ১০ সেকেন্ড সময় নেয়, একটা কল আসলে রিসিভ করতে গিয়ে ডিসপ্লে আটকে থাকে, আর পাবজি বা ফ্রি-ফায়ার খেলার কথা তো বাদই দিলাম—ল্যাগ করতে করতে মেজাজটাই খারাপ হয়ে যায়। আমরা অনেকেই তখন ভাবি, "মনে হয় ফোনের মেয়াদ শেষ, এবার নতুন কিনতে হবে।" অথবা ভাবি কোম্পানিগুলো ইচ্ছে করেই ফোন স্লো করে দিচ্ছে যাতে আমরা নতুন মডেল কিনি।
আসলে কি তাই? এর উত্তর 'হ্যাঁ' এবং 'না'—দুটোই।
বাংলাদেশের আবহাওয়া, আমাদের ব্যবহারের ধরন এবং টেকনোলজিক্যাল কিছু কারণে সময়ের সাথে সাথে ফোন স্লো হওয়াটা স্বাভাবিক। তবে হতাশ হওয়ার কিছু নেই। আজকের এই আর্টিকেলে আমরা একদম গভীরে গিয়ে জানব কেন আপনার আদরের ফোনটি স্লো হচ্ছে এবং কোনো টাকা খরচ না করেই কীভাবে একে আবার নতুনের মতো ফাস্ট করবেন।
পর্ব ১: ফোন কেন স্লো হয়? (সমস্যার ময়নাতদন্ত)
ফোন স্লো হওয়ার পেছনে মূলত ৪টি বড় কারণ কাজ করে। এগুলো টেকনিক্যাল হলেও আমি সহজ বাংলায় বুঝিয়ে বলছি।
১. অপারেটিং সিস্টেম ও অ্যাপ আপডেট (ওজন বেড়ে যাওয়া)
খেয়াল করে দেখবেন, আপনি যখন ফোনটি কিনেছিলেন তখন হয়তো অ্যান্ড্রয়েড ১০ বা ১১ ছিল। এখন হয়তো ১২ বা ১৩ চলছে। ফোনের হার্ডওয়্যার (প্রসেসর, র্যাম) কিন্তু সেই ২ বছর আগেরটাই আছে, কিন্তু সফটওয়্যার দিন দিন ভারী হচ্ছে।
ব্যাপারটা অনেকটা এমন—একজন মানুষকে দিয়ে আগে ১০ কেজি চালের বস্তা টানানো হতো, এখন তার বয়স বেড়েছে কিন্তু তাকে দেওয়া হচ্ছে ২০ কেজির বস্তা। সে তো ধীর হবেই!
ফেসবুক, মেসেঞ্জার বা ইউটিউব—এই অ্যাপগুলো আগে ৫০-৬০ মেগাবাইট ছিল। এখন আপডেট হতে হতে একেকটা অ্যাপ ৩০০-৪০০ মেগাবাইট জায়গা নেয়। এই ভারী অ্যাপগুলো লোড করতে পুরোনো প্রসেসরের ঘাম ছুটে যায়।
২. স্টোরেজ বা মেমোরি ফুরিয়ে যাওয়া (সবচেয়ে বড় কারণ)
আমাদের দেশের মানুষের একটা সাধারণ অভ্যাস হলো—মেমোরি ফুল না হওয়া পর্যন্ত আমরা ডিলিট করি না। ফোনের স্টোরেজ (ROM) যখন ৮০-৯০% ভরে যায়, তখন ফোন শ্বাস নিতে পারে না।
ফোনের ইন্টারনাল মেমোরি বা NAND Flash Storage-এর একটি নিয়ম আছে। এটি যত খালি থাকবে, তত দ্রুত কাজ করবে। যখনই এটি ভরে যায়, তখন কোনো ফাইল খুঁজে বের করতে বা ওপেন করতে প্রসেসরের অনেক বেশি সময় লাগে। হাজার হাজার গুড মর্নিং মেসেজ, হাই-ডেফিনিশন ভিডিও আর অপ্রয়োজনীয় স্ক্রিনশট আপনার ফোনকে তিলে তিলে মেরে ফেলছে।
৩. ব্যাটারির রাসায়নিক ক্ষয় (The Chemical Aging)
এটা অনেকেই জানেন না। ব্যাটারি পুরোনো হলে শুধু চার্জ কম থাকে তা না, এটি ফোনকে স্লোও করে দেয়।
লিথিয়াম আয়ন ব্যাটারি সময়ের সাথে দুর্বল হয়। যখন ব্যাটারি বেশ পুরোনো হয়ে যায়, তখন এটি প্রসেসরকে পর্যাপ্ত ভোল্টেজ দিতে পারে না। তখন ফোন যাতে হুট করে বন্ধ না হয়ে যায়, সেজন্য প্রসেসর ইচ্ছে করে নিজের গতি কমিয়ে দেয় (একে বলা হয় Throttling)। অ্যাপল একবার এই কাজ করে বেশ বিতর্কে পড়েছিল, কিন্তু সব ফোনেই এই মেকানিজম কাজ করে। বাংলাদেশের গরমে ব্যাটারি আরও দ্রুত নষ্ট হয়, ফলে ১.৫ - ২ বছরের মাথায় পারফর্মেন্স ড্রপ করে।
৪. ব্যাকগ্রাউন্ড প্রসেস এবং ক্যাশ মেমোরি
আপনি হয়তো ফেসবুক মিনিমাইজ করে হোয়াটসঅ্যাপে গেলেন, এরপর ইউটিউবে। আপনি ভাবছেন আগের অ্যাপগুলো বন্ধ হয়ে গেছে। আসলে তা নয়। র্যামের ভেতর ওগুলো ঘাপটি মেরে বসে আছে। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে আমরা প্রচুর সোশ্যাল মিডিয়া অ্যাপ ব্যবহার করি (Whatsapp, Messenger, Imo, Viber)। এগুলো সবসময় ব্যাকগ্রাউন্ডে চলতে থাকে যাতে মেসেজ আসলে আপনি সাথে সাথে নোটিফিকেশন পান। এই "সবসময় সজাগ" থাকার বিষয়টি আপনার ফোনের রিসোর্স খেয়ে ফেলে।
পর্ব ২: ফোন ফাস্ট করার ১০টি কার্যকরী উপায় (সমাধান)
সমস্যা তো জানলাম, এবার সমাধান কী? ফোন বদলানোর আগে নিচের এই স্টেপগুলো ফলো করুন। গ্যারান্টি দিচ্ছি, আপনার ফোন নতুনের মতো না হলেও, অন্তত আগের চেয়ে দ্বিগুণ স্পিডে চলবে।
১. ডিজিটাল ঝাড়ু দিন (স্টোরেজ ক্লিন করুন)
প্রথম কাজ, স্টোরেজ খালি করা।
হোয়াটসঅ্যাপ ও মেসেঞ্জার ফোল্ডার: ফাইল ম্যানেজারে গিয়ে হোয়াটসঅ্যাপের 'Media' ফোল্ডার চেক করুন। হাজার হাজার সেন্ট আইটেম বা অপ্রয়োজনীয় ভিডিও জমে আছে। সব ডিলিট করুন।
Google Files অ্যাপ: সব অ্যান্ড্রয়েড ফোনে এখন 'Files by Google' থাকে। সেখানে 'Clean' ট্যাবে গিয়ে Junk Files ডিলিট করুন।
লক্ষ্য: আপনার ফোনের মেমোরি অন্তত ২০% খালি রাখতেই হবে। ৬৪ জিবি ফোন হলে অন্তত ১০-১২ জিবি খালি রাখুন।
২. লাইট অ্যাপের দুনিয়া (Lite Apps)
আপনার ফোন যদি মিড-রেঞ্জ বা পুরোনো হয়, তবে মেইন ফেসবুক অ্যাপ ব্যবহার করা পাপ।
Facebook-এর বদলে Facebook Lite।
Messenger-এর বদলে Messenger Lite।
YouTube-এর বদলে ব্রাউজার বা YouTube Go (যদি সাপোর্টেড থাকে)।
এই লাইট অ্যাপগুলো র্যাম ও প্রসেসরের ওপর খুব কম চাপ দেয় এবং ডেটাও সাশ্রয় করে।
৩. অ্যানিমেশন স্কেল কমানো (প্রো টিপস)
এটা একটা জাদুকরী ট্রিক। ডেভেলপার অপশন অন করে ফোনের অ্যানিমেশন স্পিড বাড়িয়ে দিন।
কীভাবে করবেন: Settings > About Phone > Build Number-এ গিয়ে ৭ বার ট্যাপ করুন। 'You are now a developer' লেখা আসবে।
এবার Settings > System > Developer Options-এ যান।
নিচের দিকে স্ক্রল করে ৩টি অপশন খুঁজুন:
Window animation scale
Transition animation scale
Animator duration scale
এই তিনটাই ডিফল্টভাবে 1x থাকে। এগুলোকে .5x (পয়েন্ট ফাইভ) করে দিন।
ফলাফল: এবার ফোনের ব্যাক বাটন বা অ্যাপ ওপেন করে দেখুন। মনে হবে রকেটের গতিতে কাজ করছে!
৪. ক্যাশ মেমোরি (Cache) পরিষ্কার করুন
প্রতিটি অ্যাপ ব্যবহারের সময় কিছু টেম্পোরারি ফাইল জমা করে, যাকে Cache বলে। মাঝেমধ্যে এটা পরিষ্কার করা জরুরি।
Settings > Apps-এ যান। যে অ্যাপগুলো বেশি ব্যবহার করেন (যেমন Facebook, Chrome, YouTube), সেগুলোতে ঢুকে Storage অপশনে যান এবং 'Clear Cache' দিন।
সতর্কতা: ভুল করেও 'Clear Data' দেবেন না, তাহলে আবার লগইন করতে হবে। শুধু 'Clear Cache' দেবেন।
৫. বাজে লঞ্চার ও লাইভ ওয়ালপেপার বাদ দিন
প্লে-স্টোর থেকে অনেকেই হাবিজাবি 3D Launcher বা ব্যাটারি সেভার অ্যাপ নামান। এগুলো ফোন ফাস্ট করার বদলে উল্টো স্লো করে দেয় এবং অ্যাড দেখায়।
ফোনের ডিফল্ট লঞ্চার ব্যবহার করুন। অথবা খুব হালকা 'Nova Launcher' ব্যবহার করতে পারেন।
লাইভ ওয়ালপেপার (যেগুলো নড়াচড়া করে) দেখতে সুন্দর হলেও এটি জিপিউ (GPU)-এর ওপর লোড ফেলে। সাধারণ কালো বা ডার্ক ওয়ালপেপার ব্যবহার করুন, ব্যাটারিও বাঁচবে।
৬. অটো-আপডেট বন্ধ রাখা
প্লে-স্টোরের সেটিংসে গিয়ে 'Auto-update apps' অপশনটি 'Don't auto-update apps' করে দিন। কারণ, আপনি হয়তো গেম খেলছেন বা জরুরি কাজ করছেন, পেছনে গুগল প্লে-স্টোর ভারী আপডেট শুরু করে দিল—এতে ফোন সাথে সাথে স্লো হয়ে যাবে। আপনার সময়মতো ম্যানুয়ালি আপডেট দিন।
৭. রিস্টার্ট বা রিওবুট (সবচেয়ে সহজ সমাধান)
আমরা অনেকে মাসের পর মাস ফোন বন্ধ করি না। অথচ একটা সাধারণ 'Restart' ফোনের র্যাম থেকে সব জঞ্জাল পরিষ্কার করে দেয়। নিয়ম করুন, প্রতি ৩ দিনে অন্তত একবার ফোন রিস্টার্ট দেবেন। এতে সিস্টেম রিফ্রেশ হয়।
৮. ব্যাটারি হেলথ চেক ও রিপ্লেসমেন্ট
যদি দেখেন ফোন খুব গরম হচ্ছে এবং চার্জ দ্রুত ফুরিয়ে যাচ্ছে, তবে বুঝবেন ব্যাটারিই ভিলেন। ব্যাটারি খুব দুর্বল হয়ে গেলে ফোন পারফর্মেন্স কমিয়ে দেয়। ২ বছর পার হলে ভালো কোনো সার্ভিস সেন্টার থেকে অরিজিনাল ব্যাটারি লাগিয়ে নিন। দেখবেন ফোন আবার নতুনের মতো স্পিড পাচ্ছে।
৯. ফ্যাক্টরি রিসেট (শেষ অস্ত্র)
ওপরের কোনো কিছুতেই যদি কাজ না হয়, তবে বুঝতে হবে সফটওয়্যারে বড় কোনো ঝামেলা বা ভাইরাস আছে।
প্রথমে সব ছবি, কন্টাক্ট ও তথ্যের ব্যাকআপ নিন (পিসিতে বা গুগল ড্রাইভে)।
তারপর Settings > System > Reset Options থেকে 'Erase all data (factory reset)' দিন।
রিসেট দেওয়ার পর ফোনটি একদম কেনার সময়ের মতো ফ্রেশ হয়ে যাবে। তবে এটা করার পর আবার সব অ্যাপ ইনস্টল করার ঝামেলা পোহাতে হবে।
১০. গরম থেকে সাবধান!
বাংলাদেশ গ্রীষ্মপ্রধান দেশ। ফোন ব্যবহার করার সময় যদি দেখেন খুব গরম হয়ে গেছে, তবে সাথে সাথে ব্যবহার বন্ধ করুন। অতিরিক্ত তাপ প্রসেসরের কার্যক্ষমতা কমিয়ে দেয়। রোদে দাঁড়িয়ে বেশিক্ষণ হেভি গেম খেলবেন না।
উপসংহার
ফোন স্লো হওয়া একটি স্বাভাবিক প্রক্রিয়া, এটি এড়ানোর উপায় নেই। হার্ডওয়্যার পুরোনো হবেই। কিন্তু ওপরের টিপসগুলো মেনে চললে আপনি আপনার ফোনের আয়ু আরও ১-২ বছর বাড়িয়ে নিতে পারবেন অনায়াসেই। প্রতি ৬ মাস অন্তর ফোন পরিবর্তন না করে, একটু যত্ন নিলেই হাজার হাজার টাকা সাশ্রয় করা সম্ভব। মনে রাখবেন, ফোন আপনার গোলাম, আপনি ফোনের গোলাম নন—তাই ফোনকে নিজের সুবিধামতো কাস্টমাইজ করে নিন।
আপনার ফোন কি স্লো? আজই টিপসগুলো অ্যাপ্লাই করুন এবং কমেন্টে জানান কোনো পরিবর্তন পেলেন কি না!